ভারতের রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কি ছিল ? এর কারণ প্রভাব ও ফলাফল আলোচনা করো

WhatsApp Channel Join Now

প্রশ্নঃ- ভারতের রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কি ছিল ? এর কারণ প্রভাব ও ফলাফল আলোচনা করো।

ভূমিকা:- উপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের রেলপথ গঠনের প্রতিষ্ঠাতা এদেশের অর্থনীতিকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছিল। ভারতে 1432 থেকে রেলপথ স্থাপনে প্রস্তার করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রডলাট লর্ড ডালহৌসির আমলে ” গ্রেট ইন্ডিয়ান ট্রেনিং সোলার” কোম্পানি ভারতে সর্বপ্রথম রেলপথ প্রতিষ্ঠাতা করে। লর্ড ডালহৌসি ভারতীয় রেলপথের জনক বলা হয়। তার আমলে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে ১৬ই এপ্রিল বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ২১ মাইল পথে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পরের বছর অর্থাৎ 1454 খ্রিস্টাব্দে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ২৮ মাই পথে ভারতীয় রেলপথ শুরু হয় । ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেলপথের জাতীয়করণ করা হয়। এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠাতা লাভ করে।

রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য:-

ভারতীয়দের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, সম্পূর্ণভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইংরেজরা ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ভারতের রেলপথ স্থাপনের পেছনে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী ও শাসন মূলক উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। মূলত রাজনীতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে ভারতে রেলপথ প্রতিষ্ঠাতা স্থাপন করা হয়। ভারতে রেলপথ স্থাপনের পেছনে লর্ড ডালহৌসি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এদেশে সুদক্ষ ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যে সমস্ত কারণগুলি ভারতের রেলপথ স্থাপনের ইন্ধন যুগে ছিল। তা নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলো।

১) কাঁচামাল রপ্তানি সহজ করা:-

ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলে কলকারখানা গুলিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং তারই সাথে কাঁচামালের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ভারত থেকে উৎপাদিত কাঁচামাল ইংল্যান্ডের কলকারখানা গুলিতে পাঠানো হয়। ভারতের অভ্যন্তর থেকে কাঁচামাল বন্দরে পাঠানোর দ্রুত পাঠানোর উদ্দেশ্যে রেল যোগাযোগর প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে ডক্টর সাব্যসাচী ভট্টাচার্য বলেছেন ” এইসব লাভের লোভেই ছিল আসল কথা, এদেশের অর্থনীতির আধুনিকরণ মোটেই নয়”।

২) বিলাতি পণ্যের আমদানি সহজ করা:-

ভারতের রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলে সেখানকার কলকারখানা গুলোতে প্রচুর পণ্য সামগ্রিক উৎপাদন হতে থাকে। এসব সামগ্রী ভারতের অভ্যন্তরে দুর – দুরান্তে বাজার গুলিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন অনুভূত হয়। যার ফলস্বরূপ ইংরেজরা ভারতে রেলপথের স্থাপনের চিন্তাভাবনা করে।

৩) পুঁজি বিনিয়োগ:-

শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ শিল্পপতিদের হাতে বিপুল পরিমাণে পুজি সঞ্চিত হয়। এই পুঁজি তারা ভারতের লাভজনক, নিরাপদ ও সুবিধ জনক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত ছিল। পুঁজি পতিদের কাছে ভারতের রেলপথ নির্মাণ অন্যতম লাভ জনক ও নিরাপদ ক্ষেত্র বলে মনে হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বিশাল ভারতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদান ও যোগাযোগ রক্ষা বাহিশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ, বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রোরন পাশাপাশি সেনাবাহিনীর কাজে খাদ্য ও রসদ পৌঁছে দেওয়া প্রভৃতি উদ্দেশ্যে ভারতের রেলপথ স্থাপনের ব্রিটিশ সরকার অপরিহার্য বলে মনে করেন। এছাড়া বহু ইংরেজদের কর্মসংস্থার ঘটবে বলে আশা করেন।

8) সামরিক উদ্দেশ্য:-

লর্ড ডালহৌসি ভারতে সামরিক প্রয়োজনে ভারতে রেলপথ প্রতিষ্ঠাতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। যদিও তার আগে লর্ড ডালহৌসি সামরিক প্রয়োজনে রেলপথ নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এরপর লর্ড ডালহৌসি সেই উদ্দেশ্যকেই পূরণ করতে রেলপথ নির্মাণের সূত্রপাত ঘটায়। বিশেষ করে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার রেলপথ নির্মাণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন।

৫) দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা:-

উপনিবেশিক আমলে ভারতে দুর্ভিক্ষ ছিল নিয়মিত ঘটনা। দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকায় দ্রুত খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রিক পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার রেল যোগাযোগের প্রয়োজন উপলব্ধি করে, তবে এই কারণটি বিভিন্ন পণ্ডিতগণ মেনে নিতে পারেননি।

৬) ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ নির্মাণের প্রভাব:-

ডক্টর বিপিন চন্দ্র বলেছেন যে ” ভারতে রেলপথের প্রবর্তন ভারতীয় জনজীবন, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে”। ভারতের উপনিবেশিক অর্থনীতিতে রেলপথ নির্মাণের গভীর ও সুদূর প্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই প্রভাব সদর্থক ও নঞর্থক উভয় ধরণী ছিল। যেমন –

সদর্থক প্রভাব:-

ভারতের রেলপথ নির্মাণের বিভিন্ন সদর্থক প্রভাব ছিল। সেগুলি হল –

A) প্রশাসনিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা:-

ভারতের রেলপথের বিস্তারের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠাতা হয়। ফলে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ শাসনের ভিত আরো শক্ত হয়।

B) পরিবহন বৃদ্ধি:-

পূর্ব ভারতে পশুচালিত শকট, নৌকা প্রভিতি ছিল দেশের প্রধান পরিবহন মাধ্যম। এই ব্যবস্থা ছিল ব্যয়বহুল, যোগাযোগের ব্যবহার ব্যাপক হারে দেশের দূরদূরান্তে অতি দ্রুত চলাচলের সুবিধা হওয়ায় দুর্ভিক্ষ ও খোড়ার সময় খাদ্য প্রাধান্য সহজ হয়।

C) আমদানি বৃদ্ধি:-

রেলের সহায়তায় রপ্তানি বাণিজ্যের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বিদেশি পণ্যের আমদানির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদিত শিল্পপণ্য, কাপড়, সুতো, মূলধনী সামগ্রী প্রভৃতি ভারতের বন্দর গুলি থেকে রেল যোগাযোগের মাধ্যমে সহজেই দেশের বিভিন্ন বাজারে চলে আসে। ঐতিহাসিক থনটন তাই বলেন যে ” রেলপথ দিয়েই ভারতের সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার হয়ে যায়”।

D) শিল্প স্থাপন:-

কাল মার্কস বলেছেন যে ” রেলপথ ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের প্রকৃত অগ্রদূত হবে ”। বাস্তব ক্ষেত্রে রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতের শিল্পের বিকাশের পটভূমি তৈরি হয়।

E) কর্মসংস্থান:–

ভারতে রেলপথের প্রসার শুরু হলে রেলপথ নির্মাণ রেল প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেলের নিযুক্ত মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় 2 লক্ষ 73 হাজার।

৬

F) জাতীয় ঐক্য :-

রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়। ভাষা ধর্ম ও গোষ্ঠীগত বিভেদের প্রাচীর ভেঙ্গে দিয়ে রেল ব্যবস্থা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও মতামত আদান-প্রদানের কাজে সুবিধা করে দেয়।

নঞর্থক প্রভাব:-

দাদাভাই নওরোজি, জি. ভি. যোশী, ডি. আই ওয়াচা, জি. এস আয়ার, রমেশ চন্দ্র দত্ত, বালগঙ্গাধর তিলক, প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা ভারতে রেল ব্যবস্থাকে সুনজরে দেখেননি। তাদের মতে ভারতে রেলপথের প্রসারের বিভিন্ন সদর্থক প্রভাব থাকার সত্ত্বেও এর বেশ কিছু নঞর্থক প্রভাবও ছিল। যেমন –

A) সম্পদের বাহিগমন:-

রেলপথ নির্মাণের জন্য বার্ষিক ৫ শতাংশ হার সুদে গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মূলধন বিনিয়োগ করা হয়। এর ফলে সুদ ও মুনাফা হিসেবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ প্রতিবছর ইংল্যান্ডে চলে যেতে থাকে।

B) বর্ণবৈষম্য বিভিন্ন প্রকাশ:-

রেলে ভারতীয় সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো। মালপত্র পরিবহনে ভারতীয়দের বেশি ভাড়া দিতে হতো এবং শ্রোতাউগদের যাত্রীরা ভারতীয় যাত্রীদের লাঞ্ছনা করতো।

C) এদেশে ভারী শিল্পের প্রসার না ঘটা:-

রেলের ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি গুলি ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আমদানি করে এদেশে রেলপথ নির্মিত হয়। ফলে ভারতে রেলপথ নির্মিত হলেও এদেশে ভারী শিল্পের বিশেষ প্রসার ঘটেনি।

D) কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্য:-

রেলপথের প্রসারের ফলে সরকারি উচ্চপদে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পদে শ্রোতা উদ্যোগদেই নিযুক্ত করা হতো। রেলের উচ্চপদ গুলিতে মাত্র ১০ শতাংশ ভারতীয় নিযুক্ত ছিল।

E) দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যের সর্বনাশ:-

রেলের মাধ্যমে ভারতের দূরদূরান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিলাতি পণ্যসামগ্রী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশীয় পণ্যগুলির অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় এবং দেশীয় শিল্প – বাণিজ্য মার খায়।

উপসংহার:-

ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থেই ভারতে রেলপথ প্রতিষ্ঠিত করে। ভারতে রেলপথের প্রসারের অনেক নৈতিকবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বুকানন নামে জৈনিক মার্কিন ঐতিহাসিক বলেছেন, ” স্বনির্ভরতার যে বর্ম ভারতের গ্রামগুলিতে প্রতিদিন রক্ষা করে এসেছিল, ইস্পাতের রেল সেই বর্ম ভ ভেদ করে গ্রাম জীবনে রক্ত শোষণ শুরু করে দেয়।” তবে সার্বিক বিচারে রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতীয়রা উপকৃতই হয়। ভারতের কৃষি ও শিল্পের বিকাশ রেলের মাধ্যমিক সম্ভব হয়। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের পর এই রেলের শিল্পায়নের পথে অগ্রসর হয়।